সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিবৃত্ত
সিলেট তথা সমগ্র বাংলাদেশের অন্যতম সুপ্রাচীন বিদ্যাপীঠ সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়টি সুদীর্ঘ দু'শ বছর ধরে এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে এগিয়ে চলেছে কালের যাত্রায়। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মিশনারী মিঃ এডামের পরামর্শে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়। মূলত এসময় লর্ড ম্যাকলের আধুনিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসাবেই এ কমিটি বাংলা অঞ্চলের প্রতিটি জেলায় একটি করে হাইস্কুল স্থাপন করার প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রবেশনারি স্কুলটিই বর্তমান সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। ১৮৩৬ থেকে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অতি অল্প সংখ্যাক ছাত্র নিয়ে স্কুলটির কার্যক্রম চলতে থাকে। একটি তথ্যে দেখা যায় ১৮৪১ খ্রিস্টা্দে এর ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৪ জন। ১৮৫০ সালে বিদ্যালয়টিক প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন WH.Fox । তাঁর প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টির অনেক উন্নতি হয়। ১৮৫৬ সালের দিকে ছাত্র সংখ্যা ১৬২জন। এভদসত্বেও ছাত্র সংখ্যার স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে সরকারি স্কুল হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেওয়া। হয়। তখন মিশনারী স্কুল হিসাবে এটিকে পরিচালনায় দায়িত্ব নেন মিঃ রেভারেন্ড প্রাইজ। ১৮৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত গ্রবেশিকা পরীক্ষায় এ বিদ্যালয়ের ৪ (চার) জন ছাত্র অংশ গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় মিশনারী স্কুলগুলোর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়লে তৎকালীন ভেপুটি ইনস্পেক্টর অব স্কুলস মিঃ রায় সাহেব নব কিশোর সেনের উদ্যোগে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল নবজন্ম হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন রায় সাহেব দুর্গাকুমার বসু। তখন চৌহাট্টায় মনা রায়ের টিলা (মনার টিলা) বলে অভিহিত টিলার উপর বিদ্যালয়টি অবস্থিত ছিল। পরবর্তী সময়ে লালদিঘির পশ্চিমপাতে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বিদ্যালয়টি বিধ্বস্ত হলে সাময়িকভাবে অন্যত্র বিদ্যালয়টির ক্লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় সম্ভবত ১৯৩০ সালের দিকে পুনরায় গৃহনির্মাণ করে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম পুরোদমে চলতে থাকে। ১৯৩৪ সালের দিকে সাহেব মফিজুর রহমান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কয়েক বছর পর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিদ্যালয়টিকে মিলিটারীদের জন্য রিকুইজেশন করা হয়। ঐ সময় এর কার্যক্রম স্থানীয় গভর্নমেন্ট মাদ্রাসায় পরিচালিত হয়। যুদ্ধ শেষ হলে আবার এর কার্যক্রম ক্যাম্পাসের মধ্যেই চলতে থাকে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বিশটি হাই স্কুলকে PILOT SCHEME এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐ বিশটির একটি সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। আর তখন থেকেই বিদ্যালয়টির বর্তমান এ নামটি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এ রূপলাভ করে। তবে এর মধ্যে বিদ্যালয়টিকে সিলেট অগ্রগামী বালক উচ্চ বিদ্যালয় নামে ও বিভিন্ন চিঠি পত্রের আদান প্রদান সহ পরিচিতি পাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৯১ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গ দুইটি শিফটে (প্রভাতি ও দিবা) একজন প্রধান শিক্ষক ও দুইজন সহকারি প্রধান শিক্ষকসহ ৫৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ে চলছে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম। এ বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র তাঁদের যোগ্যতায় দক্ষতায় দেশে বিদেশে সুনাম ও পরিচিতি লাভ করে আসছে। এই বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন প্রথিতযশা সাহিত্যিক, বহভাষাবিদ রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলী, সাহিত্যিক ও গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. মোঃ ফরাস উদ্দিন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মোঃ হাসান মশহুদ চৌধুরী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য প্রফেসর ড. সদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, চিত্রাভিনেতা খলিল উল্লাহ খান, জাতীয় অধ্যাপক ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ভাঃ আব্দুল মালিক, ডাঃ অরুপ রতন চৌধুরী, ডাঃ শুভাগত চৌধুরী, অধ্যাপক ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সংগীত শিল্পী শুভ্র দেব ও মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় কর্মরত তরুণ বিজ্ঞানি অমিত বিক্রম দেব প্রমুখ। একাধিক বার মাধ্যমিক পূর্যায়ে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শীর্ষস্থান লাভ করে পুরস্কার পেয়েছে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। আগামীতে ও সবার প্রচেষ্টায় এবং সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে তা সকলের একান্ত কামনা।